মুর্শিদাবাদের নবাবদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
Safiul Islam
Independent Researcher
M.A, B.Ed.
Aliah University, Kolkata
___________________________________________________________________________________
ভূমিকা:
মুর্শিদাবাদের
ইতিহাস পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।
মুর্শিদাবাদের নবাবগণ ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হলেও, পরবর্তীতে তারা এক
ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হয়ে ওঠেন। মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ
অঞ্চল, যা ১৭শ শতকের শেষের দিকে বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং দীর্ঘকাল ধরে
মুঘল, ব্রিটিশ ও অন্যান্য রাজবংশের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
মুর্শিদাবাদের
সূচনা:
মুর্শিদাবাদের
প্রাথমিক ইতিহাস মূলত নবাব মুর্শিদ কুলি খানের মাধ্যমে শুরু হয়। মুর্শিদ কুলি খান
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ান নিযুক্ত হন।
১৭০৪ সালে মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং শহরের নামকরণ করেন
মুর্শিদাবাদ, যা তার নিজের নাম অনুসারে রাখা হয়। তার শাসনামলে মুর্শিদাবাদ একটি প্রধান
বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
মুর্শিদ কুলি
খানের শাসনকাল (১৭১৭-১৭২৭):
মুর্শিদ কুলি খান
একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন এবং বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেছিলেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও মূলত বাংলা, বিহার
এবং উড়িষ্যাকে কার্যত স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। তার সময়ে মুর্শিদাবাদের অর্থনৈতিক অবস্থান
অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল, কারণ এখান থেকে কাপড়, রেশম, এবং অন্যান্য পণ্য ইউরোপীয়দের
কাছে রপ্তানি করা হতো। তিনি দাদন নামক একটি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন, যার মাধ্যমে
রাজ্যকে অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
নবাবদের প্রশাসনিক
দক্ষতা:
মুর্শিদাবাদের
নবাবেরা মূলত মুঘলদের অধীনে থাকলেও, তারা নিজেদের একটি স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা তৈরি
করেন। নবাবেরা প্রধানত স্থানীয় জমিদার ও বণিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন
এবং তাদের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। বিশেষ করে মুর্শিদ কুলি খানের সময়ে এই ব্যবস্থাটি
আরও উন্নত হয়। তিনি জমিদার ও অন্যান্য শাসনকর্তাদের থেকে কর আদায়ের ক্ষেত্রে শক্তিশালী
নীতি গ্রহণ করেন।
সিরাজউদ্দৌলার
উত্থান ও পতন (১৭৫৬-১৭৫৭):
নবাব সিরাজউদ্দৌলা
মুর্শিদাবাদের নবাব হিসেবে ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি তার নানা আলীবর্দি
খানের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। সিরাজউদ্দৌলা অত্যন্ত সাহসী ও শক্তিশালী
নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তবে তার রাজত্বকাল ছিল অত্যন্ত সংকটময়। ইংরেজদের সঙ্গে তার
সম্পর্ক প্রথম থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।
পলাশীর যুদ্ধ ও
বাংলার পতন: ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। সিরাজউদ্দৌলা
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধ
মূলত বাণিজ্য এবং রাজস্ব বিষয়ক সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়। সিরাজউদ্দৌলা যখন ইংরেজদের মাদ্রাজ
থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন, তখন ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করে মীর জাফরকে নবাব পদে বসানোর
পরিকল্পনা করে। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে এবং তিনি নিহত
হন। এই যুদ্ধে নবাবের পরাজয় মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার ইতিহাসে একটি গভীর প্রভাব ফেলে
এবং বাংলা পরিণত হয় ইংরেজদের অধীনে।
মীর জাফর এবং
তার শাসনকাল (১৭৫৭-১৭৬০):
পলাশীর যুদ্ধের
পর মীর জাফর বাংলার নবাব হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। তবে, তার শাসন ছিল পুরোপুরি ইংরেজদের
নিয়ন্ত্রণে। তিনি নবাব হলেও কার্যত ব্রিটিশদের পুতুল শাসক ছিলেন। মীর জাফরের শাসনকাল
বাংলার জন্য অত্যন্ত সংকটময় ছিল, কারণ তার শাসনে ইংরেজদের প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়
এবং বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটে।
মীর কাসিমের
শাসনকাল (১৭৬০-১৭৬৩):
মীর জাফরের পরিবর্তে
মীর কাসিমকে নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। মীর কাসিম প্রথমে ব্রিটিশদের সমর্থন পেলেও,
পরবর্তীতে তিনি ইংরেজদের শোষণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তিনি বাংলার রাজস্ব
ব্যবস্থা সংস্কার করতে চেষ্টা করেন এবং ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা কমানোর চেষ্টা
করেন। মীর কাসিমের এই পদক্ষেপ ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধের সৃষ্টি করে এবং শেষ পর্যন্ত
১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হন। এই পরাজয়ের ফলে বাংলার নবাবদের কার্যত
শেষ স্বাধীনতা হারিয়ে যায় এবং তারা পুরোপুরি ব্রিটিশদের অধীনস্ত হয়ে পড়েন।
ইংরেজ শাসনাধীন
মুর্শিদাবাদ:
বক্সারের যুদ্ধে
পরাজয়ের পর মুর্শিদাবাদের নবাবেরা শুধুমাত্র একটি নামমাত্র পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রকৃত
ক্ষমতা চলে যায় ইংরেজদের হাতে। নবাবেরা তখন থেকে শুধুমাত্র ব্রিটিশদের অধীনস্থ একটি
পুতুল শাসক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। তবে মুর্শিদাবাদ তার রাজনৈতিক গুরুত্ব হারালেও,
এখানকার নবাবেরা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
যান।
মুর্শিদাবাদের
নবাবদের সাংস্কৃতিক অবদান:
মুর্শিদাবাদের
নবাবেরা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
তারা বাংলা, উর্দু এবং ফারসি সাহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। মুর্শিদাবাদের রাজদরবার
ছিল একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে শিল্প, সাহিত্য এবং সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো।
নবাব মুর্শিদ কুলি খানের শাসনামলে এই অঞ্চলে ইসলামিক স্থাপত্যশিল্পের উন্নতি ঘটে, যেমন
মুর্শিদাবাদের হজরতী বাগ মসজিদ এবং কাটরা মসজিদ তার উদাহরণ।
উপসংহার:
মুর্শিদাবাদের
নবাবদের ইতিহাস ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি
গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নবাবদের শাসনামলে মুর্শিদাবাদ বাংলা ও ভারতবর্ষের অন্যতম প্রভাবশালী
শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদ তার স্বাধীনতা হারায়
এবং ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়। এরপরও মুর্শিদাবাদের নবাবেরা তাদের সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছিলেন, যা এখনও বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে
বিবেচিত হয়।
References
·
"History of Bengal" by R.C. Majumdar.
·
Eaton, Richard M. "The Rise of Islam and the Bengal
Frontier, 1204–1760"
·
Banglapedia: The National Encyclopedia of Bangladesh.
Post a Comment