মুর্শিদাবাদের ইতিহাস: একটি ঐতিহাসিক গবেষণা

সফিউল ইসলাম জুয়েল


ভূমিকা

মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গের একটি ঐতিহাসিক শহর, যা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবি শাসন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ এবং বাংলার সাংস্কৃতিক বিবর্তনের সাক্ষী। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত এই শহর একসময় বাংলার রাজধানী ছিল এবং এখানে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা, মসজিদ, প্রাসাদ ও সমাধিসৌধ রয়েছে। এই গবেষণা নিবন্ধে মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাস বিশদভাবে আলোচিত হবে। এখানে নবাবি আমল, ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব, স্থাপত্যিক বৈচিত্র্য এবং স্বাধীনতা পরবর্তী মুর্শিদাবাদের অবস্থার পাশাপাশি ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রচেষ্টাও গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়েছে।


প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস

মুর্শিদাবাদের ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। মুখসুদাবাদ বা মুর্শিদাবাদ নামটি নবাব মুর্শিদ কুলি খানের নামানুসারে এসেছে।

গৌড় ও সুলতানি আমল

  • মুর্শিদাবাদ অঞ্চলটি গৌড় রাজ্যের অংশ ছিল, যা পাল ও সেন বংশের শাসনে ছিল।

  • সেন রাজারা এই অঞ্চলে হিন্দু সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটান।

  • দিল্লি সুলতানির সময় (১৩০০-১৫৭৬) এই অঞ্চল ইসলামি সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের ছোঁয়া পায়।

  • হুসেন শাহি শাসকরা মুর্শিদাবাদে ইসলামী স্থাপত্য ও শিক্ষার প্রসার ঘটান।

মুঘল যুগ

  • সম্রাট আকবরের শাসনামলে মুর্শিদাবাদ মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে সুবাহ বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়।

  • ঢাকাকে মুঘল প্রশাসনের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলেও, মুর্শিদ কুলি খান ১৭০৪ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য রাজধানী ঢাকায় থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন।

  • মুঘল আমলে মুর্শিদাবাদে বাণিজ্য, শিল্প এবং স্থাপত্যের উন্নতি হয়।


নবাবি আমল: মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ (১৭০৪-১৭৫৭)

মুর্শিদ কুলি খান বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদকে রাজধানী করেন। তার শাসনামলে মুর্শিদাবাদ বাংলার প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

রাজধানী স্থানান্তরের কারণ

মুর্শিদ কুলি খান রাজধানী ঢাকাকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন মূলত প্রশাসনিক সুবিধার জন্য।

  • ঢাকার জলাভূমি ও বন্যার প্রবণতা প্রশাসনিক কাজকর্মে অসুবিধা সৃষ্টি করত।

  • মুর্শিদাবাদ ছিল ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত, যা বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত স্থান।

  • বাণিজ্যিক দিক থেকে মুর্শিদাবাদ ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও আর্মেনীয় বণিকদের আকৃষ্ট করে।

প্রধান নবাবগণ ও তাদের অবদান

  1. মুর্শিদ কুলি খান (১৭১৭-১৭২৭)

    • রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করেন।

    • ভূমি কর ব্যবস্থাকে উন্নত করেন এবং কৃষকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনেন।

    • কাটরা মসজিদ ও নিজের প্রাসাদ নির্মাণ করেন।

  2. সরফরাজ খান (১৭২৭-১৭৩৯)

    • স্বল্পকাল শাসন করলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।

    • তাঁর শাসনে বিদেশি বাণিজ্য আরও বিস্তৃত হয়।

  3. আলীবর্দী খান (১৭৪০-১৭৫৬)

    • মারাঠা আক্রমণ (বর্গী হাঙ্গামা) প্রতিহত করেন।

    • মুর্শিদাবাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেন।

    • কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার এনে কৃষকদের দুরবস্থা লাঘবের চেষ্টা করেন।

  4. সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-১৭৫৭)

    • ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্ধিত প্রভাব রুখতে চেষ্টা করেন।

    • পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হন।

    • সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়।


ব্রিটিশ শাসন ও মুর্শিদাবাদের পতন

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদ ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারাতে থাকে।

পলাশীর যুদ্ধ ও তার প্রভাব

  • পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

  • মীর জাফরকে নবাব বানানো হলেও প্রকৃত ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়।

  • মুর্শিদাবাদের নবাবরা নামমাত্র শাসক হয়ে যান এবং তাদের ক্ষমতা ব্রিটিশদের নির্দেশনাধীন হয়ে পড়ে।

রাজধানী স্থানান্তর

  • ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশরা প্রশাসনিক রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর করে।

  • মুর্শিদাবাদ একটি জেলা শহরে পরিণত হয়, যা রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারায়।

জমিদারি ব্যবস্থা ও নবাব পরিবার

  • ব্রিটিশরা পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট প্রবর্তন করে, যা জমিদারদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে।

  • নবাব পরিবারের সদস্যরা পেনশনভোগী হয়ে পড়েন।

  • নবাবরা তাদের প্রাসাদ (হাজারদুয়ারি) ও সম্পদ ধরে রাখলেও কার্যত রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।


মুর্শিদাবাদের সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যিক ঐতিহ্য

মুর্শিদাবাদে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে, যা বাংলার ইসলামী, হিন্দু এবং ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা

  1. হাজারদুয়ারি প্রাসাদ

    • নবাব নাজিম হুমায়ুন জা ১৮৩৭ সালে এটি নির্মাণ করেন।

    • বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর, যেখানে নবাবি আমলের অস্ত্রশস্ত্র, চিত্রকলা, নথিপত্র ও অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে।

  2. কাটরা মসজিদ

    • মুর্শিদ কুলি খানের সমাধিসৌধ সহ বিশাল একটি মসজিদ।

    • এটি ১৭২৩ সালে নির্মিত হয় এবং মুর্শিদ কুলি খান নিজেই এই মসজিদে সমাধিস্থ হন।

  3. নিমাকাঠি প্রাসাদ

    • ধারণা করা হয়, এটি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাসস্থান ছিল।

    • ঐতিহাসিকভাবে এটি নবাবি জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।

  4. জাহানকোষা কামান

    • বাংলার সবচেয়ে বড় কামান, যা নবাবি সেনাবাহিনী ব্যবহার করত।

    • এই কামানটি ১৭শ শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি লোহার তৈরি।


অর্থনীতি ও বাণিজ্য: মুর্শিদাবাদের প্রভাব

মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র।

বাণিজ্য ও সমৃদ্ধি

  • মুর্শিদাবাদে ওলন্দাজ, ফরাসি, ডেনিশ ও আর্মেনীয় বণিকরা ব্যবসা করতেন।

  • মসলিন, সিল্ক, অস্ত্রশস্ত্র, হাতির দাঁত ও বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য মুর্শিদাবাদ থেকে রপ্তানি করা হতো।

মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থা

  • নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সময় ‘মুর্শিদাবাদি মুদ্রা’ প্রচলিত ছিল।

  • মুর্শিদাবাদে টাকশাল স্থাপন করা হয়, যেখানে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রস্তুত হতো।


স্বাধীনতা পরবর্তী মুর্শিদাবাদ

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর মুর্শিদাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র ও ঐতিহাসিক নগরী।

ঐতিহ্য সংরক্ষণ

  • পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব দপ্তর এবং ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (ASI) মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে।

  • হাজারদুয়ারি, কাটরা মসজিদ, নিমাকাঠি প্রাসাদসহ বিভিন্ন স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে।


উপসংহার

মুর্শিদাবাদের ইতিহাস শুধুমাত্র একটি শহরের ইতিহাস নয়, এটি বাংলার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের একটি প্রতিফলন। নবাবি আমলের জাঁকজমক, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং বর্তমানে ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রচেষ্টা—সব মিলিয়ে মুর্শিদাবাদ আজও ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে একটি জীবন্ত পাঠ্যবই।


গবেষণার উৎস

  • The Riyazu-s-Salatin (গোলাম হোসেন সলিম)

  • Murshidabad: A Memoir (সৈয়দ মুহাম্মদ তাকি)

  • Archaeological Survey of India (ASI) Reports

  • পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুরাতত্ত্ব দপ্তরের নথি

  • নবাবি আমলের ইতিহাস (মুহাম্মদ মোইনুদ্দীন)

  • বাংলার নবাববংশ (জদুনাথ সরকার)

Post a Comment

Previous Post Next Post